মোছা.ফায়জুন্নাহার শান্তা
আইন ও বিচার বিভাগ (১ম বর্ষ)
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সহজতা আনলেও, এর দীর্ঘস্থায়ী পরিবেশগত প্রভাব আজ এক গভীর সংকটের রূপ নিয়েছে। বাংলাদেশে পলিথিন নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও, কার্যকর বাস্তবায়নের অভাবে এর ব্যবহার এখনও ব্যাপক।
বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার কারখানায় ১ কোটি ৪০ লাখ পিস পলিথিন ব্যাগ উৎপাদিত হয়। এদের বেশিরভাগই মাঝারি ও ছোট আকারের। অনেক কারখানায় শুধু ৫৫ মাইক্রোনের নিচে পলিথিন জাতীয় পণ্য উৎপাদিত হয়। আইন অনুযায়ী ৫৫ মাইক্রোনের নিচে পলিথিন পণ্য উৎপাদন নিষিদ্ধ।এগুলোর সিংহভাগই পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক। বিশেষজ্ঞদের মতে দেশে প্রতিদিন যে পরিমাণ পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, অনেক দেশে তা ১০ মাসেও হয় না
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার ৬৪% মানুষ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। প্রতিদিন প্রায় আড়াই কোটিরও বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয় যেখান একটি পরিবার গড়ে ৫ টি পলিথিন ব্যবহার করে।
এনভায়রনমেন্ট এন্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) নামের সংস্থার একটি হিসেবে প্রতিদিন ঢাকা শহরেই সাড়ে চার কোটি পলিথিন ব্যাগ বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেয়া হয়।
এর বেশিরভাগই আবর্জনা হিসেবে নদী ও ড্রেনে ফেলা হয়, যা জলাবদ্ধতা সৃষ্টি এবং মশার প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি করে।পলিথিন বর্জ্য মাটির উর্বরতা হ্রাস করছে, জলাধার ভরাট করছে এবং পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থায় বাধা সৃষ্টি করছে।
প্লাস্টিকের এ উপাদান মাটিতে পচতে প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ বছর সময় নেয়।
পলিথিন ব্যাগের মূল উপাদান সিনথেটিক পলিমার, যা পেট্রোলিয়াম থেকে তৈরি হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, এক টন পলিথিন ব্যাগ পোড়ালে বাতাসে ৬৩ গিগা জুল তাপ এবং ১,৩৪০ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড ছড়িয়ে পড়ে, যা বায়ু দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে।
পলিথিনের এই মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাবের কথা বিবেচনা করেই বিশ্বের ৯১টি দেশ ও অঞ্চল পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পলিথিন পুড়িয়ে ফেলা হলে বাতাসে বিষাক্ত গ্যাস নির্গত হয়, যা মানুষের শ্বাসতন্ত্রে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। জলজ প্রাণীর ওপর এর প্রভাব আরও ভয়াবহ। প্রতিদিন অসংখ্য মাছ, কচ্ছপ এবং সামুদ্রিক পাখি পলিথিন খেয়ে মারা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে একাধিক গবেষণায় লবণে এবং মাছে পলিপ্রোপেন পাওয়া যায়। এছাড়া, কৃষিক্ষেত্রে পলিথিন বর্জ্যের মিশ্রণ ফসলের উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে
পৃথিবীব্যাপী পলিথিন মহামারির চিন্তা থেকেই বাংলাদেশ সরকার বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ২০০২ সালের ১ মার্চ আইন করে পলিথিন ব্যবহার, উৎপাদন ও বিপণন নিষিদ্ধ করেন। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ ধারাটি সংযোজন করা হয়। আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন, আমদানি বা বাজারজাত করে, তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা এমনকি উভয় দণ্ডেও দণ্ডিত হতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, গত ২২ বছরে আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহার কমেনি এতটুকুও।
২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার দ্বিতীয় বারের মতো ১৭টি পণ্যের মোড়কে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন। এর পরেও বিভিন্ন সময় ধাপে ধাপে পলিথিনবিরোধী অভিযান ও নিষিদ্ধ পলিথিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে বিপুল পরিমাণ পলিথিন জব্দ করেন।
সাম্প্রতিক সময়ে সরকার পলিথিন নিষিদ্ধকরণে তোড়জোড় শুরু করেছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শান্তিমোড় এলাকার সওদাগর কুরিয়ার সার্ভিসে অভিযান পরিচালনা করে ১৫টি বস্তায় প্রায় ৮৪০ কেজি নিষিদ্ধ পলিথিন জব্দ করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর ২৬ নভেম্বর রাত সাড়ে ৯ টায়।
সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তর এবং স্থানীয় প্রশাসন পলিথিনের উৎপাদন এবং ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ আনার জন্য একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কারখানা তদারকি, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি।
পলিথিন নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি এর টেকসই বিকল্প প্রয়োজন।যেমন:
২০১৫ সালে পাট থেকে পলিথিনের বিকল্প ‘সোনালি ব্যাগ’ তৈরি করেন ড. মোবারক আহমেদ খান। এটি একটি সেলুলোজ-ভিত্তিক বায়োডিগ্রেডেবল বায়োপ্লাস্টিক, যা পরিবেশবান্ধব, মজবুত এবং বহুমুখী ব্যবহারে সক্ষম পাটের ব্যাগ।
বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষিবিদ ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আল-মামুন বলেন, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পলিথিনের ব্যাগ বিশ্বজুড়ে যখন উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তখন পাটের এই প্রাকৃতিক পলিব্যাগ বিশ্বের পরিবেশ দূষণ কমাবে। আড়ং, স্বপ্ন, আগোরাসহ দেশীয় চেইনশপগুলো এ সোনালি ব্যাগ ব্যবহার করতে আগ্রহ প্রকাশের পাশাপাশি বিশ্ববাজারে এর বিপুল চাহিদা পাওয়া যাচ্ছে।
প্রাকৃতিক উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে কাপড়, পাট, বাঁশ এবং অন্যান্য জৈব পণ্য।কাগজের ব্যাগ সহজেই পচে যায় এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য।কলাপাতা ও তালপাতার বেত দিয়ে তৈরি ব্যাগও ব্যবহার করা যায়।
২০০২ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত যখন কড়াকড়ি ছিল তখন বিকল্প উপায়েই বহন করা হতো।
জলবায়ু পরিবর্তনে যখন পুরো বিশ্ব সংকটাপন্ন সময় কাটাচ্ছে তখন আমরা কিনা পলিথিনের মতো পণ্য থেকে শুল্ক কমিয়ে আনছি। চলতি অর্থবছরের বাজেটেই এমন প্রস্তাব উঠে এসেছে। বিভিন্ন ধরনের পলিথিন ব্যাগ, প্লাস্টিক ব্যাগ ও মোড়ক সামগ্রীর ওপর বিদ্যমান ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক কমিয়ে তা ১ দশমিক ৫ শতাংশ করার কথা বলা হয়েছে।
পলিথিন নিষিদ্ধের জন্য বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, উৎপাদনকারীকে ধরতে পারছে না। এটা প্রশাসনের চরম ব্যর্থতা।নিয়মিত বাজার তদারকি, পলিথিনের বিকল্প বাজারে আনা, উৎপাদনে ভর্তুকি প্রদান,সরকারি ঋণের সহজলভ্যতা এবং আইনের নিয়মিত প্রয়োগ ও শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে পলিথিন বন্ধ করা সম্ভব।
পলিথিন থেকে পরিবেশকে রক্ষার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধিড় কোনো বিকল্প নেই। জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হলে গণমাধ্যমে সব প্ল্যাটফরমে এ বিষয়ে লেখালেখি ও প্রচার প্রচারণা বাড়াতে হবে। গণমাধ্যম সমাজের প্রতিটি স্তরে সহজে তথ্য পৌঁছে দিতে পারে। সংবাদপত্র, টেলিভিশনসহ অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্ব এবং পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে নিয়মিত প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে আরও বেশি সচেতন করতে হবে।
এছাড়া কর্মশালা এবং সেমিনারের মাধ্যমে মানুষকে পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহারের উপকারিতা এবং পলিথিনের বিপদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো যেতে পারে। এসব কর্মসূচিতে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য প্রচারের পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধি ও সৃজনশীল কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় পরিবেশ সংরক্ষণ, পলিথিন ঝুঁকি এবং প্রাকৃতিক ও বায়োডিগ্রেডেবল পণ্যের উপকারিতা নিয়ে সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। এছাড়াও বাজার করার জন্য পাটের নিজস্ব ব্যাগ বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া।
ইতোমধ্যে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন সিটি কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ শহরকে পলিথিনমুক্ত রাখতে বায়োডিগ্রেইডেইবল ব্যাগ কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং দুবাইয়ে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান মাসে ২৫ হাজার পলিব্যাগ কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বর্তমানে বছরে ৫০০ বিলিয়ন পচনশীল পলিব্যাগের বৈশ্বিক চাহিদা রয়েছে। বিশ্বের এই চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে পাটের সোনালি ব্যাগ উৎপাদন করতে পারলে তা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন ধারার সূচনা করবে বলেও মত এ বিশেষজ্ঞদের।
পলিথিন সমস্যার সমাধান রাতারাতি সম্ভব নয়। তবে দীর্ঘমেয়াদে এর বিকল্প পণ্য ব্যবহারে অভ্যস্ত হলে, পলিথিনমুক্ত এক বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব। সবার সম্মিলিত উদ্যোগেই পরিবেশ রক্ষা সম্ভব হবে। মনে রাখতে হবে, আমাদের বর্তমান প্রজন্মের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ একটি দায়িত্ব, আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এটি একটি উপহার।