জয়া রানী পাল
শিক্ষার্থী , লোকপ্রশাসন বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
মধ্যবিত্ত মানেই যেন এক অদৃশ্য অস্থিরতার নাম । তাদের কাছে গরিবদের মতো না খেয়ে থাকার ভয় নেই , ধনীদের মতো বিলাসিতার স্বপ্নও নেই । তবু প্রতিটি পদক্ষেপে একটা না-জানা দুশ্চিন্তা , একটা অদৃশ্য লড়াই ।
মধ্যবিত্ত মানেই হলো বুকের মধ্যে জমা কষ্ট লুকিয়ে রাখা , হাসি মুখে সকল কষ্ট সহ্য করে সামনে এগিয়ে যাওয়া । বাংলাদেশে বেশিরভাগ মানুষ মধ্যবিত্ত । এখানে সকল মানুষ হলো খেটে খাওয়া , পরিশ্রমী । তাদের জীবিকা নির্বাহের পথটা হয় মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জন করা , তারা রক্তকে জল করে টাকা পয়সা উপার্জন করে । তাদের কে না বলা যায় ধনী , না বলা যায় গরীব । তাই তাদের কষ্ট গুলো কেউ হয়তো বুঝে না । অর্থনৈতিক মন্দা বা জীবনের অনিশ্চিয়তায় সবথেকে চাপে থাকে এই শ্রেণীটিই । এইসব মধ্যবিত্ত পরিবারে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাবাই হলো জীবিকা নির্বাহের একমাত্র বাহন । বাবার স্বল্প আয়ের ওপরে যখন পুরো পরিবারের দায়ভার থাকে তখন ঐ বাবাই শুধু বুঝে তাদের অবস্থান । পরিবারের সদস্যদের সকল চাওয়া পাওয়া সুষ্ঠ ভাবে মিটাতে তিনি হিমশিম খেয়ে যান । এমনকি নিজের কথা না ভেবে নিজের ইচ্ছা , চাহিদা গুলো তিনি বিসর্জন দেন । ছেলে – মেয়েদেরকে ভালো স্কুলে পড়াতে গেলে মা – বাবাদের সুখ বিসর্জন দিতে হয় । কোনো একটা কিছু খরচ করতে গিয়ে তাদেরকে ভাবতে হয় এটা এই জায়গায় খরচ করলে পরবর্তীতে ছেলে মেয়ের টিউশন ফি দিতে পারবেন কি না । তাদের কষ্ট গুলো তাদের সন্তানদের কাছেও শেয়ার করে না যদি তারা কষ্ট পেয়ে তাদের স্বপ্নগুলো কে দাবিয়ে রাখে ।
একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের ব্যক্তি নিজের ইচ্ছামত সব কিছু করতে পারে না । তাকে ভাবতে হয় তার ব্যাংকের একাউন্টের দিকে । সে যখন একটা খরচ করতে যাবে তখনই মনে পরে তার সন্তানদের পরীক্ষার ফি , স্কুলের বেতন , সংসারের খরচের কথা । যখন সন্তান বাবার কাছে আবদার করে , তখন যদি বাবা সেই আবদার পূরণ করতে না পারে তখন তাঁর কষ্টের শেষ থাকে না । তাই এইসব মধ্যবিত্ত পরিবারে যেসব সন্তান বড় হয় তারা তাদের লক্ষ্যকে স্থির করেই বড় হয় । তারা সব সময় চেষ্টা চালায় যাতে তারা তাদের বাবা – মার জীবনের পূরণ না হওয়া স্বপ্নগুলো যেন পূরণ করতে পারে ।
এক মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে পড়ালেখায় ভীষণ আগ্রহী । শহরে গিয়ে পড়াশুনা করতে চায় । কিন্তু তার বাবার আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয় । তাই ছেলে কখনো তার এই ইচ্ছার কথা পরিবারকে জানায় না । তার বাবা যখন জানতে পারে তার ছেলের এই আশার কথা , তখন তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করে যেভাবেই হোক তার ছেলের এই আশা পুরণ করতে হবে । তিনি ভাবেন , “আমি আমার ইচ্ছা গুলো পূরণ না করতে পারলেও আমার ছেলের ইচ্ছা গুলো অপূরণ থাকতে দিবো না ।”
মধ্যবিত্তদের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো তাদের সামাজিক অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা । ফ্ল্যাটে থাকেন ? ভালো ব্র্যান্ডের ফোন ব্যবহার করেন ? মাঝে মাঝে পরিবার নিয়ে রেস্টুরেন্টে খেতে যান? তাহলে তো আপনি স্বচ্ছল !—এমনটাই ভাবে সমাজ । কিন্তু এই অবস্থান ধরে রাখতে গিয়ে কি পরিমান হিমশিম খেতে হয় তা শুধু মধ্যবিত্তরাই বুঝে । পরিবারের ভরণপোষণ সামলিয়ে দুই দিন পর পর রেস্টুরেন্টে যাওয়া হয় না । ফোনের স্ক্রিন অকেজো হলে ” এটাই আরো কিছুদিন চলবে ” বলে চালিয়ে দেয় , তাও নতুন ফোন কেনার কথা ভাবে না ।
ছেলে – মেয়ের জন্মদিনে কেক কাটতে ইচ্ছা করে কিন্তু তখন মনে পড়ে মাসের বাজারের হিসাব ।
একজন ব্যবসায়ী ব্যক্তি ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকে এমনকি দোকানটার জন্যও তাকে ভাড়ার টাকা গুনতে হয় । তার সমাজে পদমর্যাদা ভালো অবস্থানে আছে কিন্তু বাস্তব জীবনে সে , যে কষ্ট করে সবদিক সামলাচ্ছে মানুষ তো আর সেটা জানে না । তিনি তার ২ সন্তানদের বাইরে রেখে পড়াশুনা করাচ্ছেন । তার আয়ের টাকা ছেলে মেয়েদের পড়াশুনায় দিতে হয় আবার সংসারে দিতে হয় । তার উপরে অসুস্থতার জন্য আলাদা টাকা জমা করে রাখতে হয় । এইসব ক্ষেত্রে যখন সব চাপ পরিবারের একজন ব্যক্তিকে বহন করতে হয় তখন তার পক্ষে সব কিছু একসাথে সামাল দেয়া মুশকিল হয়ে যায় । সমাজ ভাবে , “লোকটা বড়লোক না হলে সন্তানদের বাইরে খরচ দিয়ে পড়াচ্ছেন কিভাবে ? “
মধ্যবিত্তরা গরিবদের মতো সরকারি অনুদানও পায় না আবার বড়লোকদের মতো বিনিয়োগও করতে পারে না । তারা তাদের কষ্ট গুলো জনসম্মুখেও বলতে পারে না পদমর্যাদার ভয়ে ।
এই লড়াইটা আসলে শুধু টাকার নয় , মানসিক চাপেরও । মধ্যবিত্তের দুশ্চিন্তা শুরু হয় এখনকার চাহিদা মেটানোর পরেও ভবিষ্যতের নিরাপত্তা নিয়ে । চাকরি থাকবে তো ? চিকিৎসার খরচ সামলাতে পারবো তো ? মেয়ের বিয়ে দিতে পারবো তো ? চাকরিতে কম টাকার স্যালারি তাকে বেশি করে ভাবায় তার ভবিষ্যতের কথা । সম্মানজনকভাবে উপযুক্ত পাত্রের হাতে তার মেয়েকে তুলে দিতে পারবে তো ? এই চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায় ।
এই অস্থিরতা থেকেই তারা সঞ্চয় করে , শখকে বিসর্জন দেয় , উৎসবে নিজেকে সংযত রাখে । তবু সুখের সংজ্ঞাটা সবসময় অধরা থেকে যায় ।
কিন্তু তবুও মধ্যবিত্তরা বেঁচে থাকে । তাদের লড়াই চলতে থাকে । কারণ , তারা জানে—তাদের জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো “এভাবেও চলে !”
তবে কি সত্যিই চলে ? নাকি এই ‘চলতে থাকা’ মানেই বেঁচে থাকার আরেক নাম ?